ঘরে বসে আয়ের লোভ দেখানো এসব বিজ্ঞাপনের আড়ালে রয়েছে প্রতারণার ফাঁদ। ইন্টারনেটে ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিংয়ের লোভ দেখিয়ে প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা

 

‘ঘরে বসেই মাত্র ১০০টি ক্লিক করে আয় করুন এক ডলার।’ ‘স্বল্প শিক্ষিতদের জন্য ঘরে বসে অনলাইনে আয়।’ ‘ঘরে বসে মাসে ২১ হাজার ডলার আয়।’ ‘ক্লিক করলেই টাকা।’ রাজধানীসহ সারাদেশে পথ চলতে এমন বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। ঘরে বসে আয়ের লোভ দেখানো এসব বিজ্ঞাপনের আড়ালে রয়েছে প্রতারণার ফাঁদ। ইন্টারনেটে ফ্রিল্যান্সিং এবং আউটসোর্সিংয়ের লোভ দেখিয়ে প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এরই মধ্যে স্পিক এশিয়া নামে সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে আড়াইশ’ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। এককালীন সাড়ে ৭ হাজার থেকে ২১ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে মাসে লাখ টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখায় তথাকথিত ফ্রিল্যান্সার প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ পৃথিবীতে কোনো ফ্রিল্যান্স কাজের জন্য বিনিয়োগ করতে হয় না। প্রথমে শুধু ক্লিক করেই টাকা আয়ের কথা বলা হলেও সময়মতো বেরিয়ে আসে আসল চেহারা। তখন শর্ত দেওয়া হয় আরও গ্রাহক সংগ্রহের। পুরনো সেই বাইনারি পদ্ধতিতে ‘ডান হাত’ ‘বাম হাত’-এর খেলা শুরু। ক্লিক করে আয় করা টাকা পকেটে পুরতে পারে না সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। নিজেদের ফ্রিল্যান্স কাজের জোগানদাতা হিসেবে দাবি করলেও আদতে এসব প্রতিষ্ঠানও এমএলএম কোম্পানি। বর্তমানে বাংলাদেশে এ ডিজিটাল প্রতারণায় নেতৃত্বে দিচ্ছে ডুল্যান্সার, ব্রাভো আইটি, ল্যান্সটেক, অনলাইন অ্যাড ক্লিক, পেইড টু ক্লিক, সেফটি ক্লিক, স্কাইল্যান্সার, পিটিসি ফর বিডি, অ্যাড সোর্সিং, ক্লিক টু পেইডসহ অন্তত ৩০টি প্রতিষ্ঠান। নিজেদের সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যবসা করছে তারা। যাদের অধিকাংশেরই নেই কোনো প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি বা অফিস। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের আউটসোর্সিংয়ের ফ্রিল্যান্সার প্রতিষ্ঠান বলে দাবি করে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিভাগের শিক্ষক নাশিদ শাহারিয়ার সমকালকে বলেন, এসব প্রতিষ্ঠান প্রচলিত ফ্রিল্যান্সার প্রতিষ্ঠান হতে পারে না। যেসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের কাজ বাইরের কর্মীদের মাধ্যমে করিয়ে নেয় তাকে ফ্রিল্যান্সার বলে। যারা বলে ‘ক্লিক করলেই টাকা’ তারা প্রতারণা করছে। তিনি জানান, প্রকৃত ফ্রিল্যান্সার প্রতিষ্ঠানগুলো সফটওয়্যার তৈরি, ডাটা এন্ট্রি, গাণিতিক হিসাব, অডিট, অনুবাদ, রাসায়নিক সমীকরণ তৈরি, প্রবন্ধ তৈরি, প্রতিবেদন মূল্যায়নসহ বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ অনলাইনে পাইয়ে দেয়। কাজগুলোও পেতে হয় প্রতিযোগিতামূলক নিলামের মাধ্যমে। যে যে কাজ জানেন তা নিলামের মাধ্যমে পেয়ে অনলাইনে করে জমা দিতে হয়। ক্লিক করে টাকা আয়ের কোনো ব্যবস্থা প্রকৃত ফ্রিল্যান্সার প্রতিষ্ঠানে নেই। আসল প্রতিষ্ঠানে কোনো টাকাও বিনিয়োগ করতে হয় না। যারা টাকা বিনিয়োগের কথা বলে তারা ভুয়া। তিনি ফ্রিল্যান্সারডটকম, ওডেক্সডটকমের মতো বিশ্ববিখ্যাত ফ্রিল্যান্স সাইটের কথা উল্লেখ করে বলেন, এসব সাইটে নিবন্ধনে কোনো বিনিয়োগ লাগে না। যারা কাজ জানেন তারা নিলামের মাধ্যমে কাজ নিয়ে আয় করতে পারেন; কিন্তু পড়াশোনা না জেনে শুধু বিজ্ঞাপনে ক্লিক করে টাকা আয় সম্ভব নয়। ফ্রিল্যান্স কাজে অভিজ্ঞ সফটওয়্যার প্রকৌশলী মাহমুদুল হাসান জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরেই অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছেন। মূলত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজ করে দেওয়াকেই ফ্রিল্যান্সিং বলে। তিনি জানান, ডুল্যান্সার, অনলাইন অ্যাড ক্লিক, পেইড টু ক্লিক, সেফটি ক্লিক, স্কাইল্যান্সার, পিটিসি ফর বিডি, অ্যাড সোর্সিং, ক্লিক টু পেইডের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো কাজ দেয় না। শুধু বিজ্ঞাপনে ক্লিক করে টাকা আয়ের কথা বলে। এসব প্রতিষ্ঠান প্রতারণাকারী। পেইড টু ক্লিকের প্রতারণার শিকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সুমাইয়া মৌরী। তিনি জানান, বাড়িতে বসে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করার জন্য সাড়ে ৭ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ডুল্যান্সারের সদস্য হন। অ্যাকাউন্ট খোলার সময় তাকে বলা হয়েছিল, প্রতিদিন তার ই-মেইল অ্যাকাউন্টে ১০০ লিংক আসবে। সেগুলোতে ক্লিক করলেই তার অ্যাকাউন্টে অর্থ জমা হতে থাকবে; কিন্তু টাকার দেখা পাননি। গত জানুয়ারি থেকে টাকা দেওয়া বন্ধ রেখেছে প্রতিষ্ঠান। এমনই আরেক প্রতিষ্ঠান পেইড টু ক্লিকের প্রতারণার শিকার কুমিল্লার আনিকা। স্কুলছাত্রী আনিকা লোভে পড়ে পেইড টু ক্লিকে অ্যাকাউন্ট খোলে। শর্ত অনুযায়ী দিনরাত বিজ্ঞাপনে ক্লিক করেও টাকা পায়নি সে। মাস শেষে তার অ্যাকাউন্টে ৩০ ডলার জমা দেখানো হলেও টাকা তুলতে চাইলে পেইড টু ক্লিকের পক্ষ থেকে বলা হয়, তার অ্যাকাউন্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। তাই অর্থ পাবে না। এমন করে লাখো গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করছে ফ্রিল্যান্সার দাবিদার এমএলএম কোম্পানিগুলো। নাশিদ শাহারিয়ার জানান, এসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের বিনিয়োগ আত্মসাৎ করছে, তা নয়। বরং গ্রাহকদের দিয়ে বিজ্ঞাপনে ক্লিক করিয়ে নিজেরা টাকা আয় করছে। তিনি জানান, যে ওয়েবসাইটে যত বেশি ক্লিক করা হবে তার বিজ্ঞাপনের দাম তত বাড়বে। বিজ্ঞাপনে ক্লিক করলে ওই বিজ্ঞাপনদাতারা অর্থ দেবেন। এ জিনিসটিকেই কাজে লাগাচ্ছে প্রতারকরা। তিনি জানান, সাধারণ মানুষকে দিয়ে ক্লিক করিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকরা। প্রতারণার ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে ডুল্যান্সার নামে ওয়েবসাইটভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটির দাবিকৃত সবকিছুই ভুয়া। প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ডুল্যান্সার ইউনিকরপোরেশনের বাংলাদেশি শাখা দাবি করলেও যুক্তরাষ্ট্রে এই নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। গুগলে খুঁজে এ নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ডুল্যান্সার প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের প্রতিষ্ঠার বয়স ছয় বছর দাবি করলেও প্রতিষ্ঠানটির ডোমেইন কেনা হয়েছে ২০১১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা ৪৬ মিনিটে। সে হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির বয়স মাত্র ১৫ মাস। ডুল্যান্সারের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঢাকার মিরপুরের রুকন ইউ আহমেদ নামে এক ব্যক্তি। নিজেকে প্রযুক্তিবিদ দাবি করলেও ফেসবুকে তার ফ্যান পেজ থেকে জানা যায়, ২০০২ সালে এইচএসসি ও ২০০৯ সালে অনার্স পাস করেছেন তিনি। এর বেশি তথ্য নেই পেজে। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন নুরুল বশির। ডুল্যান্সারের প্রধান কার্যালয় ধানম ির জিগাতলায় অক্ষয় প্লাজার পঞ্চমতলায়। জিগাতলায় প্রধান কার্যালয় হলেও ডুল্যান্সারের কার্যক্রম চলে কলাবাগান অফিস ও বারিধারা ডিওএইচএস অফিসে। মানুষের লোভকে কাজে লাগিয়ে প্রতারণা করছে ডুল্যান্সার। সাড়ে ৭ হাজার টাকার বিনিময়ে যে কাউকে সদস্য করা হয় এ প্রতিষ্ঠানের। আবার ৫০০ ডলার দিয়ে বেশি আয়কারী সদস্যও হওয়া যায়। সদস্য হওয়ার সময় বলা হয়, ক্লিক করলেই ডলার। কিন্তু মলয় কর্মকার নামে এক সদস্য জানান, দৈনিক ১০০টি ওয়েবসাইটের লিংক দিয়ে থাকে ডুল্যান্সার। সে লিংকগুলোতে ক্লিক করতে হয়। প্রতিটি লিংকে ৩০ সেকেন্ড করে থাকতে হয়। প্রতি ক্লিকে এক সেন্ট আর ১০০ ক্লিকে এক ডলার। কোনো সদস্য নতুন সদস্য বানাতে পারলে ৫ শতাংশ কমিশন। অর্থাৎ সেই এমএলএম পদ্ধতি। ডুল্যান্সারের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, তাদের সদস্য সংখ্যা ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৬১ জন। ৮৩৭টি প্রজেক্ট শেষে তাদের আয়ের পরিমাণ ২০ লাখ ৪৫ হাজার ৩৫৩ ডলার; কিন্তু কোনো প্রজেক্টের বিষয়ে তথ্য নেই ওয়েবসাইটে। নেই কাজদাতাদের সম্পর্কেও কোনো তথ্য। ফ্রিল্যান্সিংয়ে অভিজ্ঞ প্রকৌশলী মাহমুদুল হাসান জানান, যারা ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ দেয় অবশ্যই তাদের ওয়েবসাইটে কাজদাতা ও প্রজেক্টের বর্ণনা থাকে। নয়তো ফ্রিল্যান্সাররা কাজ নেবেন কী করে? তবে এ বিষয়ে ডুল্যান্সারের কর্ণধার রুকন ইউ আহমেদের কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। জিগাতলার অফিসে গেলে জানানো হয়, তার কোনো নম্বর কাউকে দেওয়া হয় না। এ প্রতিবেদকের ফোন নম্বর রেখে জানানো হয় পরে যোগাযোগ করা হবে; কিন্তু কেউ আর যোগাযোগ করেননি। প্রতিষ্ঠানটি ক্লিক করে টাকা নয়, গ্রাহকদের ই-মেইল ঠিকানা স্প্যামার প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির ব্যবসাও করে। এ প্রতিবেদক বিষয়টি পরীক্ষার জন্য নিজ ই-মেইল ঠিকানা একটি পেইড টু ক্লিক সাইটে নিবন্ধনের জন্য দেন। এরপর থেকেই প্রতিদিন ২০-৩০টি বিজ্ঞাপনী ই-মেইল আসতে শুরু করে। একই রকম অভিযোগ করেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাখাওয়াত হোসেন শোয়েবসহ অনেকে। অথচ সাইবার অপরাধ আইনের ৫৪(জ) ধারা অনুযায়ী ‘ইচ্ছাকৃতভাবে প্রেরক বা গ্রাহকের অনুমতি ব্যতীত, কোনো পণ্য বা সেবা বিপণনের উদ্দেশ্যে, স্পাম উৎপাদন বা বাজারজাত করেন বা করিবার চেষ্টা করেন বা অযাচিত ইলেকট্রনিক মেইল প্রেরণ’ দণ্ডনীয় অপরাধ; যার সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ড। শুধু ক্লিকের নাম করে চাকরির বিজ্ঞপ্তি, বাজি, লটারির নামে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন প্রতারণাকারী প্রতিষ্ঠান। বেট৩৫৬ডটকম, লোটোডটকম নামে প্রতিষ্ঠানগুলো লটারি জয়ের কথা জানিয়ে লোকজনকে ই-মেইল পাঠায়। ফোন নম্বর দেওয়া থাকে তাতে। ‘পুরস্কার’ হিসেবে জেতা মিলিয়ন ডলার নিতে মোবাইল ফোনে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা পাঠাতে বলে। আবু হুরায়রা আনাস নামে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বেট৩৫৬ডটকমের খপ্পরে পড়ে এক হাজার টাকা হারান। তারা মতো আরও হাজারো মানুষ প্রতিদিনই প্রতারিত হচ্ছেন।

-সমকাল

Related posts

Leave a Comment